জাতীয় প্রতিরক্ষা কলেজে 'সমসাময়িক ভারত: তার বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কৌশল এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক' শীর্ষক অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রী হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার বক্তব্য বিবৃতি ও বক্তৃতা

জাতীয় প্রতিরক্ষা কলেজে 'সমসাময়িক ভারত: তার বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কৌশল এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক' শীর্ষক অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রী হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার বক্তব্য

ভারতীয় হাই কমিশন

ঢাকা 

জাতীয় প্রতিরক্ষা কলেজে 'সমসাময়িক ভারত: তার বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কৌশল এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক' শীর্ষক অনুষ্ঠানে ভারতীয় হাই কমিশনার শ্রী হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার বক্তব্য

[ঢাকা, ১৩ আগস্ট ২০১৮]

কমান্ড্যান্ট, জাতীয় প্রতিরক্ষা কলেজ, বাংলাদেশ, লেঃ জেনারেল শেখ মামুন খালেদ, এসইউপি, আরসিডিএস, পিএসসি, পিএইচডি;

সিনিয়র ডিরেক্টিং স্টাফ, স্টাফ ও অনুষদ সদস্য;

প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেএস চীমা;

জাতীয় প্রতিরক্ষা কলেজের কোর্সের সদস্যগণ;

ভদ্র মহিলা এবং মহোদয়গণ;

বাংলাদেশের জাতীয় প্রতিরক্ষা কলেজে আসতে পেরে আজ আমি অত্যন্ত আনন্দিত এবং সম্মানিত। আমাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও সিভিল সার্ভিস থেকে জাতীয় প্রতিরক্ষা কলেজের কোর্সে অংশগ্রহণকারীদের সাথে তৃতীয়বারের মত সাক্ষাত করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আমি জেনেছি যে এনডিসি-২০১৮ এর ২৩টি কোর্সে ১২টি দেশের অংশগ্রহণকারীরা ছাড়াও ভারত থেকে তিনজন কর্মকর্তা রয়েছে। আমাকে আমার মতামত এবং অত্যন্ত দক্ষ পেশাদারদের সাথে ভাব বিনিময় করতে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এনডিসি কমান্ড্যান্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল শেখ মামুন খালেদ প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই।

২. আজকের অনুষ্ঠানের আলোচ্য বিষয় হল 'সমসাময়িক ভারত: তার বৈদেশিক নীতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কৌশল এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক'। ভারতের প্রথম বৈদেশিক এবং নিরাপত্তা নীতি এবং উন্নয়ন বিষয়ক বিষয়গুলি উপস্থাপন করার মাধ্যমে আমি আমার বক্তব্য শুরু করছি।ঘটনাক্রমে, এইসমস্তবিষয়াবলীঘনিষ্ঠভাবেআন্তঃসম্পর্কিত।আমিভারত-বাংলাদেশসম্পর্কেরসার্বিক দিকসূমুহউপস্থাপনের মাধ্যমেএটিকেঅনুসরণকরারপ্রস্তাবকরছি।

৩. টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে ভারতের বৈদেশিক ও নিরাপত্তা নীতি অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রেখে জাতীয় প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের জন্য একটি উপযোগী পরিবেশ তৈরি ও সক্ষম করাই লক্ষ্য। সম্পদ, জ্বালানী, প্রযুক্তি, সর্বোত্তম চর্চা এবং বাজারে প্রবেশাধিকার সুরক্ষিত; এবং বৈশ্বিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্মপন্থা এবং বিতর্ক নিরসনে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করছে।

৪. প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরকারের অধীনে, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানী, কর্মশক্তি ও পরিকল্পনা খাতে সক্ষমতা অর্জন করেছে যার ফলে ভারত বহিবিশ্বের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। অতীতের মত আমি গত চার বছরে সরকারের বৈদেশিক ও নিরাপত্তা নীতি কাঠামোর বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরব।

৫. আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল 'প্রতিবেশী প্রথম' নীতি গ্রহণ। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃবৃন্দকে ঐতিহাসিক আমন্ত্রণ জানানোর মাধ্যমে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে ভারত তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের ওপর গুরুত্ব দেবে। তারপর থেকে, আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় নিকট প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে সর্বাধিক গুরুত্ব এবং জোর দেওয়া হয়েছে। এটি ঘনঘন উচ্চ পর্যায়ে মতামত বিনিময়; পণ্য ও জনগণের যাতায়াতকে সহজতর করার জন্য যোগাযোগ এবং অর্থনৈতিক সমন্বয়ের উপর গুরুত্বআরোপ; স্পেস, আইটি, সাইবার সিকিউরিটি, বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মত পূর্বে অচিহ্নিত অঞ্চলগুলিতে সহযোগিতা প্রভৃতি বিষয়ে প্রতিফলিত হয়।

৬. বৈশ্বিক গুরুত্বের বিষয়গুলিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ঐক্যমত্য নির্মাণে আমাদের বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির গভীরতরকরন একটি গুরুত্বপূর্ন পূর্বশর্ত। এর মাধ্যমে আমাদের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে চার বছরে অভূতপূর্ব কূটনৈতিক প্রসার হয়েছে। মহাদেশগুলোতে ভারত এর কূটনৈতিক উদ্যোগ পুনর্বিন্যস্ত করে আরও অন্যান্য দেশগুলিতে উচ্চ পর্যায়ের সফর অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমাদের শীর্ষ নেতৃত্ব বিশ্বের প্রায় সব দেশকে সংযুক্ত করেছে, যাতে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিষয়গুলিতে সহযোগিতার পথ তৈরি হয়। এইসব দেশের মধ্যে সম্প্রতি রুয়ান্ডা এবং প্যালেস্টাইন, মঙ্গোলিয়া, পর্তুগাল, প্রথমবারের মত সরকার প্রধান পর্যায়ের সফর অনুষ্ঠিত হয়। এ ছাড়াও রয়েছে: তৃতীয় ভারত-আফ্রিকা ফোরামের সামিটে ৫৪ জন আফ্রিকান দেশের নেতাদের অংশগ্রহণ; ভারতীয় প্রজাতন্ত্র দিবস উদযাপনে ১০টি আসিয়ান প্রধান দেশ, ‘লুক ইস্ট নীতি’ থেকে ‘'অ্যাক্ট ইস্ট নীতি’র সংস্কার, পশ্চিম এশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি; 'ফোরাম ফর ইন্ডিয়া-প্যাসিফিক আইল্যান্ডস কোঅপারেশন' (এফআইপিআইসি) সামিট; প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি’র একযোগে পাঁচটি মধ্য-এশীয় দেশ সফর এবং গত বছরে অনুষ্ঠিত ভারত-নর্ডিক সামিট।

৭. বিবিআইএন ও বিমসটেকের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতার অগ্রগতির জন্য ভারত কঠিনভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই সংস্থাগুলির অধীনে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এই বছরের এপ্রিল মাসে বিবিআইএন মোটর গাড়ি চুক্তির আওতায় শিলিগুড়ি দিয়ে ঢাকা থেকে কাঠমান্ডুগামী যাত্রীবাহী বাস সার্ভিসের পরীক্ষামুলুক চালু ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আমরা বিমসটেককে অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছি। কারণ এটি আমাদের পররাষ্ট্র নীতির প্রধান দুটি দিক 'প্রতিবেশী প্রথম' এবং 'অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি'- কে আলোকপাত করে। আমরা পরের মাসে কাঠমান্ডুতে অনুষ্ঠিত বিমসটেক সম্মেলনের দিকে তাকিয়ে আছি। এই বছরের প্রথমার্ধে, বাংলাদেশ সফলভাবে বিমসটেক নিরাপত্তা প্রধান-দের এর দ্বিতীয় সম্মেলন আয়োজন করেছিল।

৮. সম্ভবত ভারত সরকারের বৈদেশিক নীতিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার বাস্তবায়ন, যা গত চার বছরে সরকারের বিভিন্ন এজেন্ডার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, বর্তমান সরকার ভারতকে পরিবর্তন করার জন্য একটি মিশন হাতে নিয়েছে। এজন্য, সরকার বিভিন্ন অঞ্চলে (মেক ইন ইন্ডিয়া), নগরায়ন অবকাঠামো (স্মার্ট শহর), দক্ষতা উন্নয়ন (স্কিল্ ইন্ডিয়া, ডিজিটাল ইন্ডিয়া) ইত্যাদি ফ্ল্যাগশিপ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ভারত সরকার ব্যবসা সহজতর উন্নতির জন্য বেশ কিছু উদারনীতি এবং সংস্কারের ব্যবস্থাও হাতে নিয়েছে। স্বাধীনতার পর এই প্রথমবার, ভারত গত বছরে বৃহৎ পরিসরে ট্যাক্সের (পণ্য এবং পরিষেবা ট্যাক্স সংস্কার) প্রবর্তন করে। প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য সহিষ্ণু জলবায়ু তৈরির লক্ষ্যে, আমাদের আন্তর্জাতিক প্রসার কার্যক্রম সতর্কতার সাথে উপযোগী ও পরিচালিত করা হয়েছে, যা আমাদের অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলির উপর আলোকপাত করতে সহায়তা করে। আমাদের আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছে এই অভূতপূর্ব প্রসার বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ, ভারতের জন্য সম্পদ সুরক্ষিত করা, আধুনিক পরিকাঠামোর উন্নয়ন এবং ফ্ল্যাগশিপ স্কিমগুলির জন্য বিদেশী দক্ষতা অর্জনে অবদান রেখেছে। এর ফলশ্রুতিতে 'উন্নয়নের জন্য কূটনীতি' ভারতের পররাষ্ট্র নীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি পরিণত হয়েছে।

৯. ভারত অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে তার উন্নয়নের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়ার নীতি ও অব্যাহত রেখেছে। গত বছর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময়ে বাংলাদেশেকে ভারতের সর্বকালেরর বৃহত্তম ঋণরেখা (শো কোটি ডলারের) প্রদানসহ প্রতিবেশীদের সঙ্গে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণে এটি সুস্পষ্টভাবে দেখা গেছে। তৃতীয় ভারত-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনে আফ্রিকার উন্নয়ন প্রকল্পসমূহের জন্য ১ হাজার কোটি ডলারের ঋণরেখাও ছিল আরেকটি বড় ঘোষণা। মারিশাস, সিসিলি, জর্ডান, ফিলিস্তিন ও মঙ্গোলিয়ার মত দেশেও লক্ষণীয় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বিদেশে ভারতের উন্নয়ন অংশীদারদের জন্য বৃত্তি ও প্রশিক্ষণ স্লটের আকারে মানব মূলধন উন্নয়ন অব্যাহত রয়েছে।

১০. সম্প্রতি সাংগ্রি-লা সংলাপের মূল ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মন্তব্য করেছিলেন যে, আমরা ‘অনিশ্চয়তা, অস্থিতিশীল প্রশ্ন ও অমীমাংসিত বিতর্ক; প্রতিযোগিতা ও দাবি; এবং সাংঘর্ষিক দৃষ্টিভঙ্গী ও প্রতিযোগিতামূলক মডেল নিয়ে বসবাস করছি। তিনি ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নিরাপত্তাহীনতা ও সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি; অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার ফলে বহিরঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি; বাণিজ্যে নতুন চিড় এবং বৈশ্বিক অভিন্ন বিষয়ে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক নীতি খর্ব করে শক্তির দম্ভ নিয়েও কথা বলেন। তিনি সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের হুমকিসহ আন্তঃসীমান্ত চ্যালেঞ্জসমূহের বিষয়েও কথা বলেন এবং মতদ্বৈধতা ও প্রতিযোগিতার উর্ধ্বে উঠে একযোগে কাজ করার আহবান জানান।

১১. এ প্রেক্ষিতে ভারত সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন, পরমাণু অস্ত্র উৎপাদন এবং বৈশ্বিক পরিচালন সংস্কারের মত অভিন্ন স্বার্থবিষয়ক আন্তর্জাতিক আলোচ্যসূচী ও বিতর্ক প্রশমনে সক্রিয় ও গঠনমূলক অবদান রেখেছে। সন্ত্রাসী ও তাদের মদতদাতাদের একঘরে করার ভারতের প্রচেষ্টার প্রতি সমর্থন ক্রমশ বাড়ছে। হামবুর্গে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে সন্ত্রাস মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ১১-দফা কর্মপরিকল্পনার প্রতি সকল দেশের সমর্থনে এটি প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলাদেশও সন্ত্রাসবাদের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এবং আমাদের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে এক মূল্যবান অংশীদার। ভারত বাংলাদেশের সন্ত্রাসের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির সমর্থক এবং এ বিষয়ে ভারত সবসময় বাংলাদেশের পাশে আছে। আমরা বিশ্বব্যাপী কালের টাকার দৌরাত্ম্য ঠেকাতেও যুদ্ধ করছি। অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণে ভারতের দ্ব্যর্থহীন অবস্থান এবং দায়িত্বশীল ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ ভারত তিনটি আন্তর্জাতিক রফতানী নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃত্ব, ওয়াসেনার চুক্তি, অস্ট্রেলিয়া গ্রুপ)-য় প্রবেশাধিকার পেয়েছে।

১২. আমরা পরিবেশে রক্ষা ও সংরক্ষণের নীতিমালার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর দানকারী দেশ। আমরা ২০৩০ সাল নাগাদ আমাদের বিদ্যুৎ সাহায্যের ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে তৈরি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। সৌরবিদ্যুৎ প্রযুক্তির অগ্রগতি ও উৎপাদন ব্যয় হ্রাসের ফলে আমরা এ লক্ষ অর্জনে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছি। ফ্রান্সের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে ভারত সফলভাবে আন্তর্জাতিক সোলার এলায়েন্স (আইএসএ) প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে, যা বিশ্বব্যাপী সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প উন্নয়নে ১২১টি অংশীদার দেশের একটি মঞ্চ সৃষ্টি করেছে। আইএসএ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উৎস থেকে ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি বিনিয়োগ সংগ্রহ করবে, যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে ১ হাজার মেগাওয়াটের চেয়ে বেশি সৌর বিদ্যুৎ সামর্থ্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবে।

১৩. সাংগ্রিলা সংলাপে তার মূল ভাষণে, প্রধানমন্ত্রী মোদী আফ্রিকার সমুদ্র সৈকত থেকে আমেরিকা পর্যন্ত ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সংযোগ বৃদ্ধির প্রতি আমাদের অন্তভুক্তিমুলুক দৃষ্টিভঙ্গির কথা ও বলেছিলেন। তিনি ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন যেটা আমরা সীমিত সদস্যদের দল হিসেবে দেখি না যা কোন দেশের উপর কর্তৃত্ব করতে চায় বা যে কোন দেশের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমাদের লক্ষ্য একটি মুক্ত, বাধাহীন এবং অন্তভুক্তিমুলুক এলাকা; দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার ভারসাম্য; সংলাপের মাধ্যমে একটি সাধারণ নীতি-ভিত্তিক ধারা; জাহাজ চলাচলে স্বাধীনতা, বাধাহীন বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী শান্তিপূর্ণ বিরোধ নিষ্পত্তি; একটি মুক্ত, নীতি-ভিত্তিক এবং স্থিতিশীল বাণিজ্য শাসনব্যবস্থা; এবং উন্নত যোগাযোগ। যাইহোক, যোগাযোগের উদ্যোগগুলি “সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা, পরামর্শ, সুশাসন, স্বচ্ছতা, কার্যকরতা এবং স্থিতিশীলতা"-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত এবং কোনও ঋণগ্রস্ত দেশগুলিকে স্থান না দেওয়া। তিনি আরও পাঁচটি মৌলিক নীতিমালা প্রণয়ন করেন যা বিশ্বজগতের সাথে ভারতের সভ্যতার ভিত্তি হবে। হিন্দিতে পাঁচটি এসএস রয়েছে: 'সমমান (সম্মান)'; 'সংবাদ (সংলাপ)'; 'সহয্য (সহযোগিতা)'; 'শান্তি (শান্তি)'; 'সমৃদ্ধি (সমৃদ্ধি)'। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের লক্ষ্য হবে একটি গণতান্ত্রিক এবং নীতি-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ধারার উন্নীতকরন; আমাদের সমুদ্র, স্পেস এবং বিমানপথগুলি মুক্ত এবং খোলা রাখা এবং দেশকে সন্ত্রাসবাদ থেকে সুরক্ষিত রাখা এবং আমাদের সাইবার স্পেস থেকে বাধা এবং সংঘাত দূর করা, আমাদের অর্থনীতি মুক্ত রাখা এবং আমাদের কার্যক্রম-এর স্বচ্ছতা বিধান এবং আন্তর্জাতিক সৌর জোটের মাধ্যমে আমাদের গ্রহের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যত।

১৪.    বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কগুলো অনেককিছুর ভিত্তিতে দেখতে হবে যা আমি পূর্বের অনুচ্ছেদগুলোতে বর্ণনা করেছি। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কগুলো বিশ্বাস এবং বন্ধুত্বের ভিত্তিতে রচিত যা কৌশলগত অংশিদারিত্বকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। আমাদের অভিন্ন মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ভাষা, আদি বংশধারা এবং অন্যান্য বিষয়ে মিল সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ একটি সম্পর্ক তৈরিতে অবদান রেখেছে।

১৫.    গত দশ বছরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়নে আমরা অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছি এবং একটি বহুমাত্রিক সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য নিরাপত্তা ও সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, ব্যবসা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, যোগাযোগ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, মহাশূন্য, উন্নয়নমূলক প্রকল্প, সংস্কৃতি এবং মানুষে-মানুষে বিনিময়সহ ব্যাপক পদক্ষেপ নিয়েছি যা বর্তমান সহযোগিতা খাতের একটি বৃহৎ অংশ পূরণ করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আমাদের সম্পর্কের বর্তমান এই পর্যায়কে `সোনালি' অধ্যায় হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

১৬.    আমরা আন্তরিক পরিবেশে আমাদের সমুদ্রসীমা ও স্থলসীমান্ত উভয় সমস্যারই সমাধান করেছি। ২০১৫ সালে ভারত ও বাংলাদেশ গত কয়েক দশক ধরে অমীমাংসিত থাকা স্থলসীমান্ত সমস্যার সমাধান করেছে। সীমান্তের উভয় পাশে অবস্থিত ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা প্রথমবারের মতো তাদের নাগরিকত্বের অধিকার পেয়েছে। সত্যি বলতে স্থলসীমান্ত চুক্তি ভারতের সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়, যা সকল অমীমাংসিত সমস্যাগুলোকে আন্তরিকভাবে সমাধান করা ও আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে ভারতের জনগণের প্রতিনিধিদের মধ্যে ঐকমত্য প্রতিফলিত করে। ২০০৪ সালে আমরা সালিশির মাধ্যমে সমুদ্রসীমা সমস্যারও সমাধান করেছি। ফলে সমুদ্র অর্থনীতি এবং সামুদ্রিক জৈবপ্রযুক্তি, দুর্যোগকালীন সাড়া প্রদান, গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা প্রভৃতি ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয়েছে। আমাদের বাহিনীগুলো এ যাবত সাফল্যের সাথে সমুদ্রে নিখোঁজ জেলেদের উদ্ধারে বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে যৌথ অনুসন্ধান ও উদ্ধার অভিযান পরিচালনা, সমন্বিত টহল ও মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগ ত্রাণ সামগ্রী (HADR) মহড়া ইত্যাদি সম্পন্ন করেছে।

১৭.    তিন বছরে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ৬০টিরও বেশি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তিগুলোর বেশিরভাগই শুধু পূর্ববর্তী চুক্তিগুলোর নবায়ন নয় বরং নতুন নতুন উচ্চ প্রযুক্তি যেমন মহাকাশ, বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি, তথ্য প্রযুক্তি ও ইলেকট্রনিক্স, সাইবার নিরাপত্তা, সমুদ্র অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সহযোগিতার সূচনা।

১৮.    যোগাযোগ ক্ষেত্রের উন্নতি বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানুষে-মানুষে সম্পর্কের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। এটি আমাদের উভয় সরকারের জন্য মনোযোগের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। গত বছর, দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথভাবে বাংলাদেশে ভারতের দেয়া প্রথম ঋণরেখার আওতায় নির্মিত দুটি প্রধান সংযোগ প্রকল্প --- দ্বিতীয় ভৈরব রেলওয়ে সেতু এবং তিতাস নদীর উপর দ্বিতীয় রেলসেতু-- উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রীদ্বয় যৌথভাবে খুলনা ও কোলকাতার মধ্যে নতুন যাত্রী ট্রেন ---বাঁধন এক্সপ্রেস-- চালু এবং কোলকাতা-ঢাকা রুটে চলাচালকারী মৈত্রী এক্সপ্রেসের যাত্রীদের জন্য নিরবিচ্ছিন্ন ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস সুবিধাও ঘোষণা করেন। রাধিকাপুর (ভারত) ও বিরল (বাংলাদেশ)এর মধ্যেকার রেলসংযোগ পুনরায় চালু করা হয়েছে এবং এর পাশাপাশি আমরা এখন চার থেকে ছয়টি রেল সংযোগ পুনরুদ্ধার করেছি যেগুলো ১৯৬৫ সালের আগে দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। এছাড়া, আগরতলা (ভারত) এবং আখাউড়ার (বাংলাদেশ) মধ্যে নতুন রেল সংযোগ স্থাপনের কাজও শুরু হয়েছে। ঢাকা-কোলকাতা, ঢাকা-আগরতলা, ঢাকা-শিলং-গুয়াহাটি এবং কোলকাতা-ঢাকা-আগরতলা রুটে বিদ্যমান বাস সার্ভিসের পাশাপাশি ২০১৭ সালে কোলকাতা-খুলনা-ঢাকা রুটে নতুন বাস সেবা চালু করা হয়েছে।

১৯.    পণ্য ও জনগণের চলাচলের জন্য নদীপথের সম্ভাবনা আহরণের উপর অধিক জোর দেয়া হয়েছে। ভারত-বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ ও বাণিজ্য প্রটোকলের আওতায় পণ্য পরিবহন এবং উপকূলীয় জাহাজ চলাচল চুক্তির আওতায় কোলকাতা ও পানগাঁওয়ের মধ্যে কন্টেইনার সেবা চালুর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশে দুটি গুরুত্বপূর্ণ নদীপথ --যমুনা নদীতে সিরাজগঞ্জ-দইখাওয়া এবং কুশিয়ারা নদীতে আশুগঞ্জ-জকিগঞ্জ-- সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নদী খননের কাজে বাংলাদেশের সাথে ভারতও অংশ নিচ্ছে। অভ্যন্তরীণ নৌ ও বাণিজ্য প্রটোকল ও উপকূলীয় রুটে যাত্রী ও জাহাজ চলাচলের গতিবিধি ও নৌচালনায় সহযোগিতা বিষয়ে সমঝোতা স্মারকের কার্যকারিতা দুটি দেশের মধ্যে নদীপথে চলাচল বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

২০.    সীমান্ত অবকাঠামোর উন্নয়ন পণ্য ও জনগণের নির্বিঘœ চলাচল নিশ্চিত করার জন্যও একটি অত্যাবশ্যক প্রয়োজনীয়তা। এই কথাটি মাথায় রেখে আমরা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে ৭টি স্থল শুল্ক স্টেশনকে সমন্বিত চেকপোস্টে উন্নীত করার কাজ করছি। এগুলি পেট্রাপোল (পশ্চিমবঙ্গ) এবং আগরতলার (ত্রিপুরা) সঙ্গে যোগ হবে, যেখানে সমন্বিত চেকপোস্টগুলো আগে থেকেই কার্যকর রয়েছে; এছাড়া ডাউকিতে  (মেঘালয়) একটি নতুন সমন্বিত চেকপোস্ট স্থাপনের কাজ চলছে। আমরা আরও সীমান্ত হাট স্থাপন করতে যাচ্ছি যেগুলো সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনযাত্রার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

২১.    এই পদক্ষেপগুলো ব্যবসা ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল যা দ্রæত সম্প্রসারিত হয়েছে, এতে করে এপ্রিল ২০১৭-মার্চ ২০১৮ বছরে মোট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। আমরা বাংলাদেশকে পূর্ণ বাজার প্রবেশ সুবিধা দিয়েছি। ফলে, ভারতে বাংলাদেশের পণ্য, বিশেষ করে তৈরি পোষাক, রপ্তানি ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রধানত: বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতের জন্য প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমানের ভারতীয় বিনিয়োগ আসছে। মিরসরাই, ভেড়ামারা ও মংলায় তিনটি ভারতীয় অর্থনৈতিক এলাকার উন্নয়ন চলছে এবং এগুলি বাংলাদেশে আরও ভারতীয় বিনিয়োগ বাড়াতে সহায়তা করবে। 

২২.    গত কয়েক বছরে বিদ্যুত ও জ্বালানি খাতে ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে ২০২১ সালের মধ্যে তার পাওয়ার টু অল স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করতে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। বর্তমানে, ভারত থেকে বাংলাদেশে ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আসছে এবং খুব শীঘ্রই এতে অতিরিক্ত ৫০০ মেগাওয়াট যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আমরা ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গ্যাস গ্রীড আন্ত:সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে যশোর-খুলনা অঞ্চলে চাহিদা কেন্দ্রগুলোতে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ, কুতুবদিয়ায় একটি তরল প্রাকৃতিক গ্যাস টার্মিনাল স্থাপন এবং এলএনজি পাইপলাইন নির্মাণের দিকে নজর দিচ্ছি। শিলিগুড়ি থেকে পার্বতীপুরে উচ্চ গতির ডিজেল সরবরাহের জন্য ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী পাইপলাইন-এর কাজ দ্রæত শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পরিচ্ছন্ন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিকল্পগুলিও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের সাথে বেসামরিক পারমাণবিক শক্তির অভিজ্ঞতা ভাগ করছি, বিশেষ করে যখন রূপপুরে দেশটির প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে।

২৩.    উন্নয়ন সহযোগিতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে মুল স্তম্ভ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বছরগুলোতে নমনীয় ঋণ থেকে শুরু করে বাংলাদেশে ভারতের উন্নয়ন সহযোগিতা আকারে ও পরিধিতে বৃদ্ধি পেয়েছে। ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমানের ভারতীয় ঋণরেখা বাস্তবায়নের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন সহযোগীতে পরিণত হয়েছে। এই ঋণের অর্থ মূলত: সড়ক, রেল, বন্দর, বিমানবন্দর, বিদ্যুত, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য ও কারিগরি শিক্ষার মতো বিভিন্ন খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই ঋণের বাইরে, আমরা বাংলাদেশে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি, সংস্কৃতি, নগর উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন খাতে আরও কিছু অনুদান প্রকল্পের কাজ হাতে নিয়েছি।  এছাড়া, আমরা পুলিশ প্রশিক্ষণ, প্রশাসনিক ক্যাডার, কাস্টমস, মাদকদ্রব্য, রেলওয়ে এবং ভারতীয় কারিগরি ও অর্থনৈতি সহযোগিতার আওতায় বিচারিক কর্মকতাদের প্রশিক্ষণ এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস প্রোগ্রামের অধীনে মেধাবী ছাত্রদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদানসহ বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে দক্ষতা উন্নয়নে সহযোগিতা করে আসছি।

২৪.    ভারত ও বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের একটি অভিন্ন ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার রয়েছে। প্রতিটি ভারতীয় এটি জেনে গর্বিত যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সৈন্য এবং মুক্তিযোদ্ধারা একসঙ্গে লড়াই করেছিল। গত বছর মাননীয় বিদেশ মন্ত্রী শ্রীমতি সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরের সময় ভারত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধের কিছু স্মারক উপহার দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রাণ বিসর্জনকারী ভারতীয় সৈন্যদের উত্তরসুরীদের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অসাধারণ সম্মান প্রদর্শন ভারতীয় জনগণের হৃদয় গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। তাদের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ, আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকারদের জন্য অতিরিক্ত ১০,০০০ শিক্ষাবৃত্তি (৪৬ কোটি টাকা সমমানের) প্রদান করছি, ভারতীয় হাসপাতালগুলোতে প্রতিবছর ১০০ মুক্তিযোদ্ধার বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান ও তাঁদের জন্য ৫-বছর মেয়াদী মাল্টিপল-এন্ট্রি ভিসা দিচ্ছি।

২৫.    আমাদের একটি চলমান ও শক্তিশালী নিরাপত্তা সহযোগিতা রয়েছে যা দুই দেশের প্রতিরক্ষা সংস্থার মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের কয়েকটি সফর ও প্রশিক্ষণ বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে আরও জোরদার হয়েছে। এই সফরগুলির মধ্যে রয়েছে ২০১৬ সালে প্রথমবারের মতো প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর। আমরা প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বিষয়ে একটি কাঠামোগত চুক্তিসহ প্রতিরক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর এবং বাংলাদেশে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যে প্রতিরক্ষা ঋণরেখা প্রদানের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই অঞ্চলে সহযোগিতা জোরদার করেছি। ‘বার্ষিক প্রতিরক্ষা সংলাপ’, দুই নৌবাহিনী কর্তৃক সমন্বিত টহল, মানবিক সহায়তার জন্য যৌথ অনুশীলন এবং দুর্যোগ ত্রাণসামগ্রীর মতো নতুন নতুন উদ্যোগগুলো আমাদের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করেছে।

২৬.    আমাদের সীমান্তরক্ষীরাও চমৎকার সহযোগিতা উপভোগ করে- হতে পারে তা তথ্য বিনিময় করে অথবা অপরাধীদের ধরার মাধ্যমে। তারা বিভিন্ন পর্যায়ে একে অপরের সাথে যোগাযোগ এবং সহযোগিতা করে এবং আন্তরিকতার সাথে অমীমাংসিত বিষয়গুলির সমাধান করে। সীমান্তকে একটি অপরাধমুক্ত এলাকা ঘোষণা করার বিএসএফ এবং বিজিবি-র সাম্প্রতিক উদ্যোগ স্বাগত জানানোর মতো একটি আস্থা সৃষ্টিকারী পদক্ষেপ যা একটি বৈধ সীমান্ত সৃষ্টিতে আমাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য অর্জনের দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সহায়তা করবে।

২৭.    গত দুই বছরে আমরা উচ্চ-প্রযুক্তির খাতগুলোতে যথা তথ্য প্রযুক্তি, মহাশূন্য, বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি, সাইবার নিরাপত্তা এবং ভূ-বিজ্ঞানে সহযোগিতা প্রাতিষ্ঠিকীকরণে সমর্থ হয়েছি। দুই প্রধানমন্ত্রী আফগানিস্তান, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলংকার নেতাদের সঙ্গে যৌথভাবে ২০১৭ সালের মে মাসে দক্ষিণ এশীয় স্যাটেলাইট উদ্বোধন করেছেন যা টেলিযোগাযোগ এবং টেলি-মেডিসিনসহ বহুমাত্রিক সুবিধা প্রদান করবে এবং বাংলাদেশসহ অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আরও ভাল সেবা প্রদান করবে।

২৮.    শেষে হলেও ন্যূনতম নয় যে আমরা মানুষে-মানুষে সংযোগ সৃষ্টিতে জোর দিচ্ছি যেটিকে আমরা আমাদের সম্পর্কের ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে মনে করি। একটি উদার ভিসা নীতি এবং বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য ভারতীয় ভিসা প্রাপ্তি সহজ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ ভারতে বাংলাদেশী নাগরিকদের ভ্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে।

২৯.    অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমাদের বিভিন্ন উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে ভারত ও বাংলাদেশ বিপুল অগ্রগতি লাভ করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে আমাদের উদ্যোগগুলো প্রমাণ করেছে যে-সহযোগিতা সেই ফলাফল এনে দিতে পারে যা আমাদের জনগণ আকাঙ্খা করে--- আমাদের মতো নিকটবর্তী দেশগুলোর একটি জয়-জয়কার পরিস্থিতি। ভারত, বাংলাদেশ এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশ,  যেগুলির অভিন্ন মূল্যবোধ ও উন্নয়নমূলক লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, নিশ্চিত করতে পারে যে পরবর্তী প্রজন্ম, যা আমাদের জনসংখ্যার প্রধান অংশ, আরও সঠিক, ন্যায়সংগত এবং সুগম্য বৈশ্বিক ক্রম দেখার প্রত্যাশা করতে পারে। এটিই একমাত্র যা অর্জনে আমরা একত্রে কাজ করতে পারি।

****