বাংলাদেশ এনডিসিতে হাই কমিশনারের বক্তৃতা
সমসাময়িক ভারত : পররাষ্ট্রনীতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কৌশল
কমান্ড্যান্ট, ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজ, বাংলাদেশ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. আকবর হোসেন
সিনিয়র ডিরেক্টিং স্টাফ, কর্মকর্তাবৃন্দ ও ফ্যাকাল্টির সদস্যগণ;
বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক সার্ভিসের বিশিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ
এনডিসি-র বিদেশি শিক্ষার্থীগণ;
ভদ্রমহিলাগণ ও ভদ্রমহোদয়গণ;
নমস্কার, আসসালামু আলাইকুম ও শুভ সকাল
১. আজ বাংলাদেশের ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে এসে আমি আনন্দিত ও সম্মানিত। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী এবং সিভিল সার্ভিস থেকে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্সে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশে বক্তব্য প্রদানের এটাই আমার প্রথম সুযোগ। আমার চিন্তাধারা প্রকাশ করে আপনাদের সঙ্গে যুক্ত হতে আমন্ত্রণ জানানোয় এনডিসি কমান্ড্যান্ট লেফটেন্যান্ট জেনারেল হোসেনকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।
২. আজকের বক্তব্যের মূলসুর ‘সমসাময়িক ভারত : পররাষ্ট্রনীতি, নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কৌশল’। শুরুতে আমি ভারতের পররাষ্ট্রনীতির মূল বিষয়গুলো তুলে ধরতে চাই। তারপরে কীভাবে পররাষ্ট্রনীতি ভারতের নিরাপত্তা ও উন্নয়ন কৌশলের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তা নিয়ে কথা বলব। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রগণ্য স্থানে থাকা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের বর্তমান অবস্থার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়ে শেষ করব।
৩. ভারতের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির আবশ্যিকতা টেকসই ও সর্বব্যাপী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষার ওপর রূপায়িত। এটি অন্তত চারটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যে আমাদের উপলব্ধির ওপর নির্ভর করে:
(ক) অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক হুমকি থেকে ভারতকে রক্ষা করা;
(খ) এমন একটি বাহ্যিক পরিবেশ সৃষ্টি করা যা ভারতের সর্বব্যাপী উন্নয়নের জন্য সহায়ক যাতে উন্নয়নের সুবিধাসমূহ দেশের দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে;
(গ) বৈশ্বিক ফোরামে যেন ভারতের কণ্ঠস্বর শোনা যায় এবং ভারত যাতে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু পরিবর্তন, নিরস্ত্রীকরণ, বিশ্বব্যাপী শাসনকার্য পরিচালনায় নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানসমূহের সংস্কার, বহুপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনা, ইন্টারনেট গভর্ন্যান্স ও সাইবার নিরাপত্তার মতো আরও নানান আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বিশ্ব মতামত গঠন করতে সক্ষম হয় তা নিশ্চিত করা; এবং
(ঘ) প্রবাসী ভারতীয়দের সংযুক্ত করে তাদের দেখভাল করা।
৪. গত প্রায় এক দশক বা তারও বেশি সময় ধরে, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি আরও সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশের সাথে ভারতের সম্পৃক্ততার কৌশলে নতুন তেজ, প্রাণশক্তি ও পরিকল্পনা অর্জন করেছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থসমূহ সংরক্ষণের প্রকৃতি এবং ভারতের বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে উল্লেখযোগ্য বিবর্তন ঘটেছে। আজকের বিশ্বব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে ভারত আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অগ্রাধিকারসমূহ নিরূপণে ইচ্ছুক ও সক্ষমরূপে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা এই বিষয়ে সচেতন যে, আজকের বৈশ্বিক গতিশীলতার পরিবর্তনে জাতীয় স্বার্থের সংরক্ষণ সহজ নাও হতে পারে তবে এটি সম্পাদন করতে হবে।
৫. ভারতের বিপুল জনসংখ্যা, বিশ্বের ৫ম বৃহত্তম হিসেবে স্থান অধিকারী এর বৃহৎ অর্থনীতি এবং এর উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি – আমরা এই বছর বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল প্রধান অর্থনীতিতে পরিণত হব বলে অনুমান করা হচ্ছে – এই সকল বিষয় আজ ভারতকে বিশ্বব্যাপী বিশিষ্টতার সন্ধানে আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী একটি দেশে পরিণত করেছে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে কুয়ালালামপুরে আসিয়ান (ASEAN) বিজনেস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট সামিটে প্রদত্ত বক্তৃতায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের গুরুত্ব সম্পর্কে আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন ভারতের পালা৷ এবং আমরা জানি যে আমাদের সময় এসেছে।’
৬. ভারত আজ গর্বিত বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ভারতও সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করে যে, ক্ষমতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বও ন্যস্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন বা বৈশ্বিক অতিমারি বা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ – এই সকল গুরুতর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রচেষ্টায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার মাধ্যমে ভারতের ক্রমবর্ধমান ভূমিকা প্রকাশ পায়।
৭. প্রধানমন্ত্রী মোদি ২০১৮ সালে শাংগ্রি-লা সংলাপে তার মূল বক্তব্যে পাঁচটি মৌলিক নীতির রূপরেখা প্রদান করেন যার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের সাথে ভারতের সম্পৃক্ততা স্থাপিত হবে। হিন্দিতে রয়েছে এই পাঁচটি এস (S) : সাম্মান (সম্মান); সাম্বাদ (সংলাপ); সাহইয়োগ (সহযোগিতা); সান্তি (শান্তি); এবং সামৃদ্ধি (সমৃদ্ধি)। প্রধানমন্ত্রী মোদি তখন যেমন বলেছিলেন, আমাদের ফোকাস থাকবে চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে :
ক. একটি গণতান্ত্রিক ও নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রচার;
খ. আমাদের সমুদ্র, মহাকাশ ও আকাশপথকে অবাধ ও উন্মুক্ত রাখতে, সন্ত্রাসবাদ থেকে আমাদের জতিসমূহকে সুরক্ষিত রাখতে এবং আমাদের সাইবার স্পেসকে ব্যাঘাত ও সংঘাত থেকে মুক্ত রাখতে অন্যদের সাথে কাজ করা;
গ. আমাদের অর্থনীতিকে উন্মুক্ত রাখা এবং আমাদের সম্পৃক্ততাকে স্বচ্ছ রাখা; এবং
ঘ. আমাদের গ্রহটির জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যতের অন্বেষণ করা।
৮. বিশ্বমঞ্চে ভারত তার ক্রমবর্ধমান ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন এবং উপলব্ধি করে যে তার উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা পূরণের উদ্দেশে গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ এই অঞ্চল ও বিশ্বের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বৈশ্বিক মঙ্গলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে নিতে ভারতের সদিচ্ছা এবং সর্বজনীন শান্তি, উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির লক্ষ্যে ভারতের অন্বেষণ তার বসুধৈব কুটুম্বকম্ দর্শনে মূর্ত হয়েছে, যা হলো সংস্কৃতে একটি অভিব্যক্তি, যার অর্থ সমগ্র বিশ্ব একটি পরিবার। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. জয়শঙ্কর সম্প্রতি যেমন বলেছেন, এটার অর্থ হলো বিশ্ব আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং আমরাও বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই বিশ্বাসটি প্রথম সাড়া প্রদানকারী হিসেবে আমাদের বহু সংখ্যক কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায়─হোক সেটা কোভিড-১৯ অতিমারি যখন তুঙ্গে তখন ১৫০টিরও বেশি দেশে ভ্যাকসিন ও ওষুধ সরবরাহ; বা বিস্তৃত ভৌগোলিক বিপর্যয়ের সময় মানবিক সহায়তা প্রদান─যেমন নেপালে ভূমিকম্প, ইয়েমেনে গৃহযুদ্ধ, মোজাম্বিকে সাইক্লোন, ফিজিতে টাইফুন, শ্রীলঙ্কায় মাটিধস ইত্যাদি। এটি আরও দৃশ্যমান হয় যখন ভারত আন্তর্জাতিক সৌর জোটের (ইন্টারন্যাশনাল সোলার অ্যালায়েন্স) মতো বৈশ্বিক উদ্যোগের মাধ্যমে প্যারিস চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়।
৯. উদীয়মান আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির আরেকটি মুখ্য দিক হলো ‘প্রতিবেশী প্রথমে’ (‘নেবারহুড ফার্স্ট’) নীতি─যা এমন একটি অঞ্চলের ওপর গুরুত্বারোপ করে, যেখানে রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সর্বজনীন ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন। আমি আগেই বলেছি, নেবারহুড ফার্স্টের বিনির্মাণে বাংলাদেশ একটি অগ্রণী অবস্থানে রয়েছে। যেমনটা আমাদের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীমতি সুষমা স্বরাজ ২০১৭ সালে তাঁর বাংলাদেশ সফর চলাকালে বলেছিলেন – ‘পাড়োসি পেহেলে, অউর পাড়োসি মে বাংলাদেশ সাবসে পেহেলে’, যার অর্থ, আমাদের কাছে প্রতিবেশী প্রথমে, কিন্তু এমনকি প্রতিবেশীদের মধ্যেও বাংলাদেশ প্রথমে।
১০. ‘প্রতিবেশী প্রথমে’ নীতির লক্ষ্যগুলো আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর লক্ষ্য ও আকাঙ্ক্ষার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে যে প্রাধান্য আমাদের প্রতিবেশীরা পেয়ে থাকে, তা আপনারা দেখতে পাবেন সাম্প্রতিক কিছু উন্নয়নে – যেমন বাংলাদেশের সাথে আমাদের ঐতিহাসিক সীমান্ত চুক্তি; নেপালে ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে ভারতের জরুরি ত্রাণ প্রদান এবং দীর্ঘমেয়াদী পুনর্গঠন কার্যক্রম; স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে শ্রীলঙ্কার জনগণের প্রচেষ্টায় ভারতের অব্যাহত সমর্থন; ভুটানের সাথে আমাদের পরম্পরাগতভাবে ঘনিষ্ঠতা এবং দ্বিপাক্ষিক কল্যাণমূলক সম্পর্কের সুসংহতকরণ; এবং চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা সরবরাহের মাধ্যমে আফগানিস্তানের জনগণের প্রতি আমাদের টেকসই প্রতিশ্রুতি ও সমর্থন প্রদান এর কয়েকটি উদাহরণ।
১১. এছাড়াও, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য একটি বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গির রূপরেখা প্রদান করেছে ভারত – যাকে বলা হয় ‘অঞ্চলের সকলের জন্য নিরাপত্তা ও উন্নতি’ বা সাগর (SAGAR) হলো একটি শব্দ-সংক্ষেপ, হিন্দিতে যার অর্থ ‘সমুদ্র’। সাগর হলো আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির অভিযোজনের একটি উদাহরণ। সাগরের (SAGAR) লক্ষ্য ভারত মহাসাগরে জলদস্যু কার্যক্রম, চোরাচালান, পরিবেশগত অবক্ষয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো সর্বজনীন হুমকিসমূহ মোকাবিলায় ক্রমবর্ধমান ভারতীয় সক্ষমতাকে ব্যবহার করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে।
১২. ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য প্রবণতা সম্ভবত ভারতের উন্নয়নমূলক আকাঙ্ক্ষা পূরণের লক্ষ্যে আমাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পুনর্বিন্যাসকরণ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, অভ্যন্তরীণ উন্নয়ন সাধনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এবং একই সাথে আমাদের অর্থনৈতিক লক্ষ্যসমূহে গুরত্ব প্রদানকে নিশ্চিত করতে একটি আঞ্চলিক নিরাপদ পরিবেশ নিয়ে কাজ করার উদ্দেশে পরিকল্পিতভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রচারণা চালানো হয়েছে। অবকাঠামো, বিনিয়োগ, পরিবহণ, জ্বালানি ইত্যাদির প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিসমূহকে আকর্ষণ করাও এর মাঝে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
১৩. আমাদের আন্তর্জাতিক সহযোগীদের কাছে একটি অভিনব আউটরিচ কর্মকাণ্ড বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নতুন প্রযুক্তিতে অ্যাক্সেস, ভারতের জন্য সম্পদ সুরক্ষিতকরণ, আধুনিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আমাদের ফ্ল্যাগশিপ স্কিমসমূহের জন্য বিদেশি দক্ষ জনবল আনয়নের ক্ষেত্রে অবদান রেখেছে। এইভাবে ‘উন্নয়নের জন্য কূটনীতি’ ভারতের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম পরিচায়ক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। পণ্য ও পরিষেবা উভয় ক্ষেত্রে বাণিজ্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় ভারত কর্তৃক আরোপিত অপরিসীম গুরুত্ব বজায় রাখার জন্য অনুকূল ভিত্তি বিনির্মাণে এবং আমাদের আইটি শিল্পের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দক্ষ কর্মীদের তৎপরতাকে সুরক্ষিত করতে আমাদের আগ্রহের দিকেও নজর রেখে আমাদের বাণিজ্য-কূটনীতিকে প্রস্তুত করা হয়েছে।
১৪. প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি আত্মা নির্ভার ভারাত বা একটি ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর স্বপ্ন দেখেন - যা বিশ্ব থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নয়, বরং স্বদেশে সক্ষমতা বৃদ্ধি করে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও স্থিতিস্থাপক হয়ে ভারত কার্যকরভাবে বিশ্বের দরবারে অবদান রাখতে পারে। আমরা বিশ্বাস করি ভারত তার আকার, সক্ষমতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ে অতিমারি পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পুনর্জাগরণে একটি মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে প্রস্তুত।
১৫. স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ৭৫ বছর পূর্ণ করেছে ভারত। ৭৫ বছর বয়সে, আমরা বিশ্বাস করি যে ভারত আজ অবিস্মরণীয় অগ্রগতির শীর্ষে রয়েছে। ‘নতুন ভারত’-এ পরিণত হওয়ার এই রূপান্তর শুধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য নয়। এটি সুশাসন, জনগণের অংশগ্রহণ ও ক্ষমতায়নকেও অন্তর্ভুক্ত করে – বিশেষ করে প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে, এবং একটি সর্বব্যাপী ও টেকসই উন্নয়ন মডেল যা উন্নতি ও পরিবেশের মধ্যে সামঞ্জস্যতা অর্জন করে সবার জন্য সুবিধা নিয়ে আসবে।
১৬. অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য, গত কয়েক বছরে বেশ কিছু নতুন উদ্যোগ চালু করা হয়েছে। ফিনান্সিয়াল ইনক্লুশন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ যা বাস্তবায়নের ৮ বছরে ৪৭০ মিলিয়নেরও বেশি (৪৭ কোটি) সুবিধাভোগীকে তাদের অ্যাকাউন্টে প্রায় ১.৮ বিলিয়ন (১৮০ কোটি) টাকা এনে দিয়েছে। সকলের জন্য আবাসন সুবিধা প্রদান করার লক্ষ্যে গ্রামীণ ও শহর উভয় এলাকায় প্রায় ২৭০ মিলিয়ন (২৭ কোটি) নতুন বাড়ি গরিবদের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে। আমাদের রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি আয়ুষ্মান ভারত, যার লক্ষ্য দেশের নিম্ন আয়ের জনগণের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্য বীমা কভারেজ প্রদান করা। ভারত আজ ডিজিটাল অর্থনীতি ও নগদহীন সমাজের দিকে তার যাত্রায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বিশ্বে আমাদের ডিজিটাল লেনদেনের সংখ্যা সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন। এই উন্নয়নমূলক প্ল্যাটফর্মসমূহের মধ্যে অনেকগুলোই বহু উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জন্যও আগ্রহের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে, যারা আমাদের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়ে আগ্রহী।
১৭. সংযোগের আমাদের পররাষ্ট্রনীতি কানেক্টিভিটির ওপর গুরুত্বারোপের মাধ্যমে আমাদের সর্বজনীন আঞ্চলিক সমৃদ্ধি পরিবেশন করার ব্যাপারে সম্যাভিমুখী। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের কানেকটিভিটি-সংক্রান্ত সহযোগিতা এরই একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ। বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) ও বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টোরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন (বিমসটেক)-এর মতো বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কানেক্টিভিটি উদ্যোগসমূহের মাধ্যমে আঞ্চলিক সহযোগিতা এগিয়ে নিতে ভারত প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা বিমসটেককে উচ্চ গুরুত্ব প্রদান করি কারণ এটি আমাদের পররাষ্ট্র নীতির দুটি প্রধান দিককে স্পর্শ করে – ‘প্রতিবেশী প্রথমে’ এবং ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’।
১৮. ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি’-এর আরও একটি বিবর্তন হলো ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন, যা ২০১৮ সালে শাংগ্রি-লা সংলাপে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেন। ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চল সেই অঞ্চল, যেখানে বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৬৫% জনগণ বাস করে এবং গ্লোবাল জিডিপির প্রায় ৬০%-এ অবদান রাখে। বিশ্বের প্রায় অর্ধেক বাণিজ্য হয় এই অঞ্চলের সামুদ্রিক বাণিজ্য রুট দিয়ে। ভারত মহাসাগরের বৃহত্তম অর্থনীতি ও বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে উল্লেখযোগ্যভাবে একীভূত একটি দেশ হিসেবে, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নে আমাদের সহজাত আগ্রহ রয়েছে। ভারত একটি মুক্ত, উন্মুক্ত, সর্বজনীন, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের কল্পনা করে, যা একটি নিয়ম-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা, নৌচলাচল ও ওভার-ফ্লাইটের স্বাধীনতা, বাধাবিহীন আইনসম্মত বাণিজ্য, বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে, দেশগুলোর সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা। আসিয়ান-কেন্দ্রিকতা আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন হলো উন্নয়ন ও সংযোগের একটি ইতিবাচক গঠন, যাতে ভারত তার ভৌগোলিক অবস্থান ও অর্থনৈতিক শক্তির ভিত্তিতে একটি অনন্য ভূমিকা পালন করতে পারে। কিছু অর্থে, সহযোগিতা ও সংযোগের মাধ্যমে যৌথ সমৃদ্ধির ওপর জোর দিয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি অর্থনৈতিক অগ্রাধিকার রয়েছে। অবশ্যই এই অর্থনৈতিক প্রাধান্যের ক্ষেত্রে, নিয়ম-ভিত্তিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
১৯. সহযোগিতার এই দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবায়ন করতে, ২০১৯ সালে পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে, প্রধানমন্ত্রী মোদি আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক ওশান্স ইনিশিয়েটিভস (IPOI)-কে আরও স্পষ্ট করেছেন, যা এই সাতটি শীর্ষ ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব-ভিত্তিক সহযোগিতার জন্য একটি বিশদ রূপরেখা প্রদান করে─সামুদ্রিক নিরাপত্তা; সামুদ্রিক পরিবেশবিদ্যা; সামুদ্রিক সম্পদ; সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সম্পদ বিনিময়; দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস ও ব্যবস্থাপনা; বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও একাডেমিক সহযোগিতা; এবং বাণিজ্য সংযোগ ও পরিবহণ।
২০. ভারতের ইন্দো-প্যাসিফিক স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে, আমরা আসলে বহু ক্ষেত্রে অগ্রসর হয়েছি। কোয়াড হলো এমনই একটি প্ল্যাটফর্ম - এটি মূল্যবোধ ও স্বার্থের মিলনের ওপর ভিত্তি করে সৃষ্ট একটি বহুপাক্ষিক মঞ্চ, যা সমসাময়িক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে এবং ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরে সহযোগিতার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সুযোগসমূহ কাজে লাগানোর জন্য ব্যাবহারিক সহযোগিতার দিকে প্রস্তুত। কোয়াড টিকা উন্নয়ন, জলবায়ু-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড, অবকাঠামো উন্নয়ন, সংযোগ, মানবিক সহায়তা ও দুর্যোগকালীন ত্রাণ, সাইবার নিরাপত্তা থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য এমনকি মহাকাশবিষয়ক সহযোগিতার মতো বিভিন্ন ব্যাবহারিক কার্যক্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে।
২১. ভারতও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে তার উন্নয়ন অভিজ্ঞতা বিনিময় করার নীতি অব্যাহত রেখেছে। এটি সকলের জানা নাও থাকতে পারে, তবে ভারত ৬৫টিরও বেশি দেশে ভারতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রকল্পের (আইডিইএএস-IDEAS) অধীনে রেয়াতি লাইন অফ ক্রেডিট (LOCs) আকারে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যমানের উন্নয়ন সহায়তা সম্প্রসারিত করেছে। বাংলাদেশ আমাদের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী, যার কাছে আমরা প্রায় ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের উন্নয়ন প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছি। আমাদের প্রতিবেশীদের বাইরে, আমরা আফ্রিকায় উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের লাইন অফ ক্রেডিট সম্প্রসারিত করেছি। বৃত্তি ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন ভারতের উন্নয়ন অংশীদারিত্বের একটি বিশাল অংশ।
২২. আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, ভারত বিশ্বব্যাপী এজেন্ডা গঠনে এবং সন্ত্রাস, জলবায়ু পরিবর্তন, পারমাণবিক বিস্তার ও বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা সংস্কারের মতো সর্বজনীন স্বার্থের বিষয়ে বিতর্কের জন্য সক্রিয় এবং গঠনমূলক অবদান রাখে। মাত্র কিছুদিন আগে, মুম্বাইতে ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের কাউন্টার টেরোরিজম কমিটির বৈঠকের আয়োজন করেছিল যেখানে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় ‘নতুন এবং উদীয়মান প্রযুক্তি’-র ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বাংলাদেশও সন্ত্রাসবাদ থেকে উৎসারিত কিছু গুরুতর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে এবং সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে একটি অমূল্য সহযোগী। ভারত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো-টলারেন্স’ নীতিকে পূর্ণ সমর্থন জানায় এবং এই ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে অবস্থান করে। আমরা বিশ্বব্যাপী কালো টাকার হুমকির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যও জোর দিয়েছি। ভারতের অনবদ্য বৃদ্ধিহীন রেকর্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ, ভারত তিনটি মূল বৈশ্বিক রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা─ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ওয়াসেনার চুক্তি এবং অস্ট্রেলিয়া গ্রুপেও প্রবেশ করেছে।
২৩. আমরা পরিবেশগত সুরক্ষা ও সংরক্ষণের নীতির প্রতিও প্রতিশ্রুতিশীল এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছি। দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সকলের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা, আবাসন ও বিদ্যুৎ নিশ্চিত করার বিশাল কর্মযজ্ঞ সত্ত্বেও, ভারত গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমণ হ্রাস করার সঙ্গে সঙ্গে প্রাথমিকভাবে সুবিধা প্রদানকারী প্রশমন প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার’- ২০২০ সালের নভেম্বরে অনলাইন জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে করা একটি মূল্যায়ন, ভারতের জলবায়ু অ্যাকশন এনডিসি লক্ষ্যকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে অভিহিত করার মাধ্যমে এটি নির্দেশ করে যে ২০৩০-এর জন্য ভারতের জলবায়ু প্রতিশ্রুতিকে তার দায়িত্ব এবং সামর্থ্যের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার ন্যায্য অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। জি২০-ভুক্ত কোনো রাষ্ট্র এর চেয়ে বেশি অনুকূল রেটিং পায়নি। প্রধানমন্ত্রী মোদি ২০২১ সালে গ্লাসগোতে COP 26-এ ভারতের জন্য পাঁচটি উচ্চাভিলাষী নতুন জলবায়ু লক্ষ্যমাত্রার রূপরেখা প্রদান করেছেন - ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০০ গিগাওয়াট অ-জীবাশ্ম জ্বালানি উৎপাদন, ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহার করে ভারতের শক্তির চাহিদার ৫০% পূরণ করা, ২০২১ সাল থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতের কার্বন নিঃসরণ ১ বিলিয়ন টন হ্রাস করা, ২০৩০ সালের মধ্যে ভারতীয় অর্থনীতির কার্বনের তীব্রতা ৪৫% হ্রাস করা এবং ২০৭০ সালের মধ্যে নেট জিরো কার্বন নিঃসরণে পৌঁছানো।
২৪. ভারতের রয়েছে বিশ্বের বৃহত্তম নবায়নযোগ্য শক্তি সম্প্রসারণ কর্মসূচি যার প্রায় ১৭৫ গিগাওয়াটই আসছে বিভিন্ন নবায়নযোগ্য উত্স থেকে৷ গত প্রায় আট বছরে, সৌরশক্তি ক্ষমতা ২.৬ গিগাওয়াট থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৬ গিগাওয়াটেরও অধিক হয়েছে এবং স্থাপিত নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষমতা ২৮৬% বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ, স্থাপিত নবায়নযোগ্য শক্তির দিক থেকে সামগ্রিকভাবে ভারত ৪র্থ বৃহত্তম রাষ্ট্র৷
২৫. গত মাসে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী লাইফ আন্দোলন শুরু করেছেন যার উদ্দেশ্য পরিবেশের জন্য জীবনযাত্রা বিনির্মাণ। ভারতের নেতৃত্বে এটি একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলন যার লক্ষ্য পরিবেশ রক্ষা ও সংরক্ষণের জন্য ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত পদক্ষেপ নিশ্চিত করা। ভারতের তিনটি বৈশ্বিক উদ্যোগ - ফ্রান্সের সাথে যৌথভাবে ২০১৫ সালে চালু করা ‘আন্তর্জাতিক সৌর জোট’; যুক্তরাজ্যের সাথে যৌথভাবে দুর্যোগ প্রতিরোধী পরিকাঠামোর জন্য জোট; এবং যুক্তরাজ্য ও বিশ্বব্যাংকের সাথে ‘এক সূর্য, এক বিশ্ব, এক গ্রিড’ উদ্যোগ - বৈশ্বিক জলবায়ু ক্রিয়াকলাপের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য ভারতের সদিচ্ছার দৃষ্টান্ত।
২৬. আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকারসমূহের পরিচর্যা করার সময়ও কোভিড-১৯ অতিমারিতে ভারতের সাড়াদান থেকে বৈশ্বিক মঙ্গলের জন্য আমাদের পররাষ্ট্রনীতির বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। আমাদের কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডের পথে অতিমারিকে আমরা আসতে দেইনি। বিশ্বব্যাপী সমৃদ্ধি ও সহযোগিতার কেন্দ্রে মানবতাকে স্থাপন করার যে স্বপ্ন প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে, তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, অতিমারির মধ্যেও ভারত স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রদানকারী হিসেবে সক্রিয় ছিল। এখন পর্যন্ত আমাদের ‘ভ্যাকসিন মৈত্রী’ উদ্যোগের অধীনে বাংলাদেশসহ ১০০টিরও বেশি দেশে মেড-ইন-ইন্ডিয়া ভ্যাকসিনের ২৭০ মিলিয়ন (২৭ কোটি) ইউনিট রপ্তানি করেছে ভারত। কোভিড-১৯ অতিমারির মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জসমূহকে আরও কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে আমাদের সহায়তা করার জন্য আরও ন্যায়সঙ্গত বৈশ্বিক ব্যবস্থা এবং একটি সংশোধিত বহুপাক্ষিকতার জন্যও আমরা জোর গলায় কথা বলেছি।
২৭. আগামী মাসে শুরু হতে যাওয়া জি২০-এ ভারতের আসন্ন প্রেসিডেন্সি এমন একটি সময়ে আগত যখন বিশ্বব্যাপী আর্থ-সামাজিক অবস্থা পুনরুদ্ধার কার্যক্রম কোভিড-১৯ অতিমারির ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে এবং ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলাফলের সাথে মোকাবিলা করতে লড়াই করছে। তবে ভারত এই দায়িত্ব নিতে উন্মুখ। জি২০ প্রেসিডেন্সি আমাদের এজেন্ডা নির্ধারণ এবং এই কঠিন সময়ে সামষ্টিক কল্যাণের নিমিত্তে বিশ্বব্যাপী প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের গুরুতর চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় আমাদের নেতৃত্বের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। আমরা আনন্দিত যে আমাদের আমন্ত্রণে, বাংলাদেশ অতিথি রাষ্ট্র হিসেবে এই আলোচনায় যোগ দিতে যাচ্ছে।
২৮. পরিশেষে, আমি কিছু মুখ্য বিষয়ের ওপর আলোকপাত করতে চাই যার মাধ্যমে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির রূপরেখা বাংলাদেশের সাথে আমাদের সম্পর্কের সরাসরি প্রতিফলন খুঁজে পায়, যা আমাদের সর্বাধিক বিশেষ সম্পর্কগুলোর একটি। আমি এটিকে আমাদের কর্মযজ্ঞের ছয়টি বিস্তৃত বৈশিষ্ট্যে ভাগ করব :
ক. কৌশলগত প্রাধান্য: আমরা সৌহার্দ্যপূর্ণভাবে আমাদের সমুদ্র ও স্থল সীমানার সমাধান করেছি। আমরা স্বীকার করি, ছিটমহলের প্রকৃত বিনিময় কোনো গড়পড়তা অর্জন নয়। অন্য কথায়, এই কর্মকাণ্ড সম্ভব করতে উভয় পক্ষই রাজনৈতিক পুঁজি ব্যয় করেছে।
খ. কৌশলগত আস্থা: আমরা বেশ কয়েকটি নিরাপত্তা চুক্তি (ফৌজদারি বিষয়ে পারস্পরিক আইনি সহায়তা; সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের স্থানান্তর, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদ, সংগঠিত অপরাধ ও অবৈধ মাদক পাচার বিরুদ্ধে লড়াই, জাল নোটের প্রচলন প্রতিরোধে সমঝোতা স্মারক এবং মানব পাচার প্রতিরোধ এবং প্রত্যর্পণ চুক্তি) সমাপ্ত ও কার্যকর করার মাধ্যমে কৌশলগত আস্থার ক্ষেত্রে একটি কাঠামো রচনা করেছি। এগুলো নিশ্চিত করেছে যে প্রতিবেশী হিসেবে, আমরা উভয় পক্ষের জন্য জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি মানব দুর্বলতার জটিলতাগুলো পরিচালনা করতে পারি।
গ. সমগ্র ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা: এককভাবে সরকার গৃহীত পদ্ধতিতে, আমরা গত সাত বছরে প্রায় ১২০টি সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সম্পন্ন করেছি, নিরাপত্তা থেকে শুরু করে পুলিশিং, কাস্টমসের মতো বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে মহাকাশ প্রযুক্তি পর্যন্ত নানান কার্যকলাপের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে সহযোগিতামূলক ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়েছে।
ঘ. জনগণকেন্দ্রিক নীতিমালা: আস্থা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি বাণিজ্য, সংযোগ ও মানুষে মানুষে যোগাযোগের ওপর নিষেধাজ্ঞাসমূহকে উল্লেখযোগ্যভাবে সহজতর করেছে। বহুমুখী পরিবহণ সংযোগ - যেমন উপকূলীয় শিপিং, অভ্যন্তরীণ জলপথ, সড়ক, রেল ও বিমান - নানান জটিল প্রক্রিয়া ও অবকাঠামোর মাধ্যমে সম্পন্ন হয় যার মধ্যে রয়েছে দুটি সমন্বিত চেক পোস্ট এবং আরও সাতটি সমন্বিত চেক পোস্ট আপগ্রেডেশনের অধীনে রয়েছে আর সীমান্তে রয়েছে ২৬টি কার্যকরী স্থল কাস্টমস স্টেশন৷ ভ্রমণের সুবিধার্থে একটি উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টাও রয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভিসা কার্যক্রমের আয়োজক। আমরা ২০১৯ সালে প্রায় ১.৬ মিলিয়ন (১৬ লাখ) ভিসা প্রদান করেছি। কোভিডের সময়, আমরা প্রতিবছর প্রায় ৩,০০,০০০ ভিসা প্রক্রিয়াকরণ করেছি যার মধ্যে প্রায় ২,৩০,০০০ মেডিকেল ভিসা অন্তর্ভুক্ত ছিল। গত বছরের শেষের দিকে সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর, আমরা এই বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৮,২৫,০০০ ভিসা প্রদান করেছি।
ঙ. পারস্পরিক কল্যাণ: বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্পর্ক বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ এই অঞ্চলে আমাদের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার। আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক কাঠামোগতভাবে ত্রুটিপূর্ণ এমন ধারণার বিপরীতে, ভারত তিন ধরনের পণ্য - মদ, অস্ত্র ও তামাকজাত পণ্য বাদে ভারতের বাজারে বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার রয়েছে। ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্যের এই পাল্লা আমাদের দিকে ঝুঁকে থাকলেও, এটা বাংলাদেশের রপ্তানি আয়েও উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমানে ভারত এশিয়ায় বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি গন্তব্য হয়ে উঠেছে, বিগত চার বছরে গড়ে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রপ্তানি হয়েছে এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে এই অংক ২ বিলিয়ন ছুঁয়েছে। আমরা একটি সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব চুক্তির (কম্প্রিহেনসিভ ইকনোমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট - সেপা) ব্যাপারে অগ্রগতি সাধনে আগ্রহী, যা এলডিসি মর্যাদা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ছাড়াও ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্ভাবনাসমূহকে সুরক্ষিত করবে।
আমাদের অংশীদারিত্বের আরেকটি হচ্ছে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ খাত। বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির সাথে নিবন্ধিত ভারতীয় বিনিয়োগের প্রস্তাবনা ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এছাড়াও, বিদ্যুৎ ও শক্তি, রসদ, শিক্ষা, আইটি ও চিকিৎসা খাতে ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ভারতীয় বিনিয়োগ পাইপলাইনে রয়েছে। মোংলা ও মীরসরাইয়ে নির্মিতব্য ভারতীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল বাংলাদেশে ভারতীয় বিনিয়োগকে আরও সহজ করবে।
চ. উন্নয়ন অংশীদারিত্ব: বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের উন্নয়ন সহযোগিতা কার্যক্রম প্রায় ৭.৮৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রেয়াতি লাইন অফ ক্রেডিট-এর মাধ্যমে কার্যকর করা হচ্ছে – যার মাঝে অন্যান্য রেয়াতযোগ্য ক্রেডিট লাইন অন্তর্ভুক্ত নয়, যার মূল্য আরও প্রায় ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এটি উল্লেখযোগ্য যে ৬৫টি দেশে সম্প্রসারিত ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ক্রেডিট লাইনের মোট প্রতিশ্রুতির মধ্যে ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের সাথে। এই ক্রেডিট লাইনসমূহ বাংলাদেশের জন্য স্বতন্ত্রভাবে অত্যন্ত কম খরচে ও সুবিধাজনক শর্তে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এছাড়াও, আমরা স্বাস্থ্য, পানি, নগর উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির মতো বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশে অনুদান প্রকল্প গ্রহণ করছি। বাংলাদেশের সাথে আমাদের উন্নয়ন সহযোগিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো বেসামরিক কর্মচারী, বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা, পুলিশ বিশেষজ্ঞদের জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ কর্মসূচি এবং প্রকৌশল থেকে কলা পর্যন্ত বিস্তৃত ক্ষেত্রগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি। আমরা বাংলাদেশে ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যমানের একটি প্রতিরক্ষা লাইন অফ ক্রেডিটও সম্প্রসারিত করেছি।
২৯. বন্ধুরা, আবারও বলতে চাই ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে রয়েছে গভীর সম্পর্ক : একটি অভিন্ন ইতিহাস, সংস্কৃতি, জাতিগোষ্ঠী এমনকি গণহত্যা থেকে জনগণের মুক্তির জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার অনন্য বিশেষত্ব।
৩০. অভিন্ন ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক শিকড়ের মতো আমাদের উভয় জাতির ভবিষ্যৎও আন্তঃসম্পর্কিত, আমরা আজ আমাদের বন্ধনে একটি ‘সোনালি অধ্যায়’ বা একটি ‘সুবর্ণ যুগের’ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার দ্বারপ্রান্তে।
৩১. আর তাই, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে যখন আপনারা এই কোর্স থেকে স্নাতক হয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হবেন এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতির বিবর্তনে অবদান রাখবেন, আমি নিশ্চিত যে আপনারা অনেকেই আমাদের ভবিষ্যতের ‘সোনালি অধ্যায়’-এর স্থপতি হবেন।
৩২. আমি আবারও কমান্ড্যান্ট ও এনডিসিকে ধন্যবাদ জানাই এই সম্মানিত শ্রোতাগণের সামনে আমার চিন্তাধারা তুলে ধরার সুযোগ দেওয়ার জন্য।
৩৩. আপনাদের সবাইকে অসংখ্য ধন্যবাদ!
***
৬ নভেম্বর ২০২২