ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ৮ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে হাই কমিশনারের বক্তব্য বিবৃতি ও বক্তৃতা

ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ৮ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে হাই কমিশনারের বক্তব্য

ভারতীয় হাই কমিশন

ঢাকা

ইন্দিরাগান্ধীসাংস্কৃতিককেন্দ্রের৮মপ্রতিষ্ঠাবার্ষিকীউদযাপনঅনুষ্ঠানেহাইকমিশনারেরবক্তব্য

প্রধানমিলনায়তন, বাংলাদেশজাতীয়জাদুঘর, ঢাকা

[০৯মে২০১৮, সন্ধ্যা৬.৩০টা]

জনাব আসাদুজ্জামান নূর, মাননীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী, বাংলাদেশ,

বিশিষ্ট অতিথিবর্গ,

ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ,

ঢাকাস্থ ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের (আইজিসিসি) ৮ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমি আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। এই আট বছরে আমাদের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে যেগুলো দুই দেশের মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক বৃদ্ধি করেছে।

২. অভিন্ন সংস্কৃতির কারণে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক অনন্য। উভয় দেশের মানুষ তাদের হাজার বছরের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম রচিত গান ও কবিতা, বাউল ও লোকসংগীত, ধ্রুপদী পারফর্মিং আর্ট এবং ভিজ্যুয়াল আর্টসমূহ উভয় দেশেই উত্সাহ এবং আনন্দের সাথে চর্চা করা হয়। ভারত ও বাংলাদেশের বহুসংখ্যক শিল্পী প্রতিবছর দুই দেশে সফর করেন যা দুই দেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক সম্পর্ককে গভীর করে।

৩. আমাদের অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকার ২০১০ সালে ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশন্স (আইসিসিআর) এর অধীনে ঢাকায় ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২০১০ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের পর থেকেই কেন্দ্রটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সাংস্কৃতিক বিনিময়ের প্রসারে জড়িত রয়েছে।

৪. ইন্দিরা গান্ধী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের একটি প্রধান কাজ হল ভারতীয় সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন করা। হিন্দি, যোগ, হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় কণ্ঠ্য সংগীত, তবলা, মণিপুরী ও কত্থক নৃত্য এবং চিত্রকলা বিষয়ক সংক্ষিপ্ত কোর্স পরিচালিত হয়ে থাকে কেন্দ্রে। এই কোর্সসমূহ খুবই জনপ্রিয় এবং আমি আনন্দের সাথে বলতে চাই যে, প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী আমাদের কেন্দ্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়। গত পাঁচ বছরে দশ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশী শিক্ষার্থী আইজিসিসিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন।

৫. সংগীত ও নৃত্যানুষ্ঠান, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, ভারতীয় ও বাংলাদেশী চলচ্চিত্র এবং তথ্যচিত্র প্রদর্শন, চলচ্চিত্র উৎসব, শিল্প প্রদর্শনী, বইয়ের উদ্বোধনী, বক্তৃতা, আলোচনা সভা এবং যোগ বিষয়ক কর্মশালা, হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় কণ্ঠ্য ও যন্ত্র সংগীত, ভারতীয় নৃত্য ও চিত্রকলাসহ সমগ্র সাংস্কৃতিক বিষয়ে কেন্দ্রের কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হয়েছে।

৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী এবং কাজী নজরুল ইসলামের "বিদ্রোহী" কবিতা প্রকাশের ৯০তম বার্ষিকী আমাদের দুই দেশের যৌথ আয়োজনে উদযাপিত হয়েছে। আমরা স্বামী বিবেকানন্দের সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীও যৌথভাবে উদযাপন করেছি। কেন্দ্রটি শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় ও বাংলাদেশী শিল্পীদের অংশগ্রহণে দু’দেশে নিয়মিত অনুষ্ঠান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে ব্যাপকভাবে সাংস্কৃতিক বিনিময় করেছে। গত তিন বছরে আইজিসিসি ২১৪টি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে যার মধ্যে ৬০টি ছিল ভারতীয় শিল্পীদের পরিবেশিত অনুষ্ঠান।

৭. আইজিসিসি আয়োজিত কিছু স্মরণযোগ্য অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে -ভারতীয় নৃত্যশিল্পী মমতা শঙ্কর-এর বক্তৃতা; বাংলাদেশে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী প্রমিতা মল্লিকের পরিবেশনা; আইসিসিআর-এর আয়োজনে রুহানি সিস্টার্স, শেহনাই দল ও সুফি বাওরার দলের বাংলাদেশ সফর; নয়াদিল্লিতে আইসিসিআর আয়োজিত দ্বিতীয় ভারতীয় ভক্তি উৎসবে লালনগীতি শিল্পী ফরিদা পারভীনের অংশগ্রহণ; আইসিসিআর লোকসংগীত উৎসবে কিরণ চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে লোকশিল্পদলের অংশগ্রহণ; ভারতে আইসিসিআর আয়োজিত অনুষ্ঠানে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও সুরের ধারা দলের সংগীত পরিবেশনা; আইজিসিসিতে কাজী নজরুল ইসলামের ভারতীয় নাতনি অনিন্দিতা কাজী ও বাংলাদেশি নাতনি খিলখিল কাজী পরিবেশিত অনুষ্ঠান।

৮. আইজিসিসি নিয়মিতভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী পালন করেছে। এছাড়া, প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী আব্দুল আলিম ও আব্বাসউদ্দিনের জন্মদিন উপলক্ষে শিল্পীদ্বয়ের সন্তানদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়, ঢাকার সহযোগিতায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছি যেমন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের পরিবেশনায় উচ্চাঙ্গ সংগীতের অনুষ্ঠান; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সহযোগিতায় দু’টি অনুষ্ঠান - বাংলাদেশের ৮ শিশুশিল্পীর পরিবেশনায় নৃত্যানুষ্ঠান এবং ২০১৭ সালে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উদযাপন; ভারতের বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞদের বক্তৃতা; সরকারি সংগীত মহাবিদ্যালয়ে শান্তিনিকেতন থেকে আসা সব্যসাচী সেরখেল-এর সেতার বাদন, নয়াদিল্লির সারথি চ্যাটার্জীর উচ্চাঙ্গ সংগীত এবং কোলকাতার পরিমল চক্রবর্তীর তবলা বাদন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের আয়োজনে আইজিসিসিতে অনুষ্ঠিত সঙ্গীতানুষ্ঠান। বাংলাদেশী শিল্পীদের অসাধারণ কিছু পরিবেশনার মধ্যে রয়েছে- অদিতি মহসিন, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, শামা রহমান-এর রবীন্দ্র সংগীত; খায়রুল আনাম শাকিল, ড. নাশিদ কামাল, ফাতেমা তুজ-জোহরার নজরুল গীতি; আইজিসিসির নৃত্যগুরু ওয়ার্দা রিহাব ও তাঁর শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় রবিঠাকুরের নৃত্যনাট্য ‘শ্যামা’; আইজিসিসি শিক্ষিকা মুনমুন আহমেদ ও তাঁর শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় কত্থক নৃত্য; বাংলাদেশের প্রখ্যাত সুরকার আজাদ রহমানের পরিবেশনায় বাংলা খেয়াল, সেলিনা আজাদের আধুনিক গান; অলক কুমার সেনের গজল, চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে পর পর দু’বছর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, যোগবিষয়ক কর্মশালা ইত্যাদি।

৯. আইজিসিসির পরিচালক শ্রীমতি জয়শ্রী কুণ্ডু’র নেতৃত্বে পরিচালিত আইজিসিসি দলের নিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রম ছাড়া এ অনুষ্ঠানগুলির কোনটিরই আয়োজন করা সম্ভব হতো না। গত তিন বছরে শ্রীমতি কুণ্ডু আইজিসিসির কর্মকাণ্ড সঠিকভাবে সম্পন্ন করা এবং এটির প্রচার ও প্রসারে তাঁর প্রতিশ্রুতি সুষ্ঠুভাবে পালন করেছেন। তাঁর মেয়াদ পূরণ ও দায়িত্বভার হস্তান্তরের প্রাক্কালে আমি তাঁর প্রতি এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ উন্নয়নের ক্ষেত্রে তাঁর অবদানের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

১০. আমি আগামী বছর বা এরকম কিছু সময়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কিত কিছু বিষয় ভাগাভাগি করতে চাই।

  • কর্মশালা/সেমিনার: আইসিসিআর-এর সামনে রাখা আমাদের অন্যতম একটি প্রস্তাব হল সংগীত ও নৃত্যকলায় বিশিষ্ট শিল্পীদের নিয়ে কর্মশালা / সেমিনারের আয়োজন। এটি বাংলাদেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করতে এবং এই ধরনের বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করতে আমাদের সহায়তা করবে।
  • প্রখ্যাত শিল্পীদের সফরঃ আইজিসিসি ভারত ও বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পীদের সফর বিষয়ে লক্ষ্য রাখবে। আমি চাই এসব শিল্পীরা যেন ঢাকা ও কোলকাতার বাইরেও নতুন নতুন শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে পারেন। আমরা একজন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীকে ভারতে পাঠাতে যাচ্ছি। ভারতের যেসব অংশে বাংলা উচ্চাঙ্গ সংগীত ততটা পরিচিত নয় তিনি সেসব জায়গাগুলোতে সংগীত পরিবেশন করছেন। তাঁর সাথে পরামর্শ করে আমরা বেঙ্গালুরু ও হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি। একটি টেলিভিশন সাক্ষাতকারে আমি আমার অভিমত দিয়েছিলাম যে, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্ক কেবল সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত নয় বরং শত নয় সহস্র বছর ধরে চলে আসা সভ্যতাগত সম্পর্ক এটি।
  • সাংস্কৃতিক কর্মসূচির জন্য অবকাঠামো: বাংলাদেশের মত একটি সাংস্কৃতিকভাবে প্রাণবন্ত সমাজে গুণগত সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। তবে, এখানে ভালমানের সাংস্কৃতিক মিলনায়তনের কমতি রয়েছে। আমরা পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পরামর্শে একটি আধুনিক সাংস্কৃতিক মিলনায়তন নির্মাণের সম্ভাবনা পরীক্ষা করছি।

১১. আমি আমাদের শিক্ষকদের প্রশংসা করছি যারা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের চমৎকার ভাবে প্রশিক্ষিত করছেন। আমি শিক্ষার্থীদেরও প্রশংসা করছি তাদের আগ্রহ,উদ্যম ও প্রচেষ্টার জন্য যার মাধ্যমে তারা জ্ঞান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন।

১২. আজকের কর্মসূচির জন্য শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য আমাদের শিক্ষক ড. যোগেশ বশিষ্ঠ, ওয়ার্দা রিহাব, মুনমুন আহমেদ এবং শ্রীমতি মাম্পি দে-কে বিশেষ ধন্যবাদ। শক্তি নোমান, শ্রী কুশল রায় এবং শ্রী শ্যামলী মণ্ডলকেও শিক্ষকতায় তাঁদের অবদানের জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

১৩. আমি বাংলাদেশের মাননীয় সংস্কৃতি মন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান নূর, বাংলাদেশ সরকার এবং সকল বাংলাদেশীকে আমাদের প্রচেষ্টা সফল করার জন্য তাদের সহযোগিতা ও শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

****